এম,এ,মান্নান, স্টাফ রিপোর্টার,নিয়ামতপুর (নওগাঁ)
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বিদ্যুতের আলোর ছোঁয়া পৌঁছে দেওয়া এখন সময়ের দাবি। কিন্তু অনেক সময় পরিকল্পনার অভাব, অসাবধানতা বা তদারকির ঘাটতির কারণে এসব উন্নয়নমূলক কাজ গ্রামীণ জনগণের জন্য আশীর্বাদের চেয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তেমনই এক ঘটনা ঘটেছে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার রসুলপুর ইউনিয়নের মানপুর গ্রামে। সেখানে দেখা গেছে—একটি পুকুরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক বিদ্যুতের খুঁটি! এই অদ্ভুত এবং বিপজ্জনক স্থাপনার কারণে চরম আতঙ্কে রয়েছে এলাকার সাধারণ মানুষ।
মানপুর গ্রামটি একটি শান্ত ও মনোরম পরিবেশে ঘেরা। গ্রামের মানুষ মূলত কৃষিকাজ, মাছ চাষ ও ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের মাঝখানে একটি বড় পুকুর রয়েছে, যেখান থেকে প্রতিদিনই কেউ না কেউ মাছ ধরে, গবাদিপশু গোসল করায় কিংবা গৃহস্থালির কাজে পানি ব্যবহার করে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যায়, ওই পুকুরের মাঝখানে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে, যার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে উচ্চ ভোল্টেজের তার। বিষয়টি দেখে স্থানীয়রা হতবাক হয়ে যায়।গ্রামবাসীর অভিযোগ, বিদ্যুৎ বিভাগের কোনো প্রকৌশলী বা তদারক কর্মকর্তা সঠিকভাবে স্থান নির্ধারণ না করেই খুঁটিটি স্থাপন করেছেন। খুঁটি বসানোর সময় গ্রামের কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও কাজের দায়িত্বে থাকা লোকজন তাদের কথা শোনেননি। ফলে এখন পুকুরটি ব্যবহার করা একপ্রকার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, “আমরা প্রতিদিন এই পুকুরে গোসল করি, গরু গোসল করাই, মাছ ধরি। কিন্তু এখন পুকুরে নামতে ভয় হয়। যদি হঠাৎ খুঁটি থেকে বিদ্যুৎ লিক করে, তাহলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।” তার মতো আরও অনেকেই একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।এদিকে এলাকার স্কুলগামী শিশুরা পুকুরের ধারে খেলাধুলা করে। তাদের নিরাপত্তা নিয়েও অভিভাবকদের মনে গভীর দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে—এই ভয়েই অনেকে এখন পুকুরের কাছেও যেতে চায় না।স্থানীয়রা একাধিকবার ইউনিয়ন পরিষদ এবং বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি হাজি সফিউদ্দিন বলেন, “আমরা বিদ্যুতের আলোর জন্য আন্দোলন করেছিলাম, কিন্তু এখন সেই বিদ্যুতের খুঁটিই আমাদের আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”এ বিষয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও বক্তব্য জানা গেছে। রসুলপুর ইউনিয়নের একজন সদস্য জানিয়েছেন, তিনি ইতোমধ্যে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবগত করেছেন এবং দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির কাছাকাছি বা পানির ভেতরে বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন করা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ পানি বিদ্যুতের পরিবাহক হিসেবে কাজ করে; তাই কোনো সামান্য ত্রুটি ঘটলেও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণহানি ঘটতে পারে।বর্তমানে গ্রামের মানুষ পুকুরটি ব্যবহার করা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এতে দৈনন্দিন জীবনে ভোগান্তি বেড়েছে। পানি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় পশুপাখির যত্ন, গৃহস্থালির কাজ ও মাছ চাষে সমস্যা দেখা দিয়েছে।এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক পরিকল্পনা ও তদারকির অভাব কেমন ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত ওই বিদ্যুতের খুঁটিটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া এবং এমন অব্যবস্থাপনা ভবিষ্যতে না ঘটানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।পরিশেষে বলা যায়, উন্নয়ন তখনই অর্থবহ, যখন তা মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে। মানপুর গ্রামের মানুষ আজও আশায় দিন গুনছে—কবে তাদের পুকুরের মাঝের সেই বিদ্যুতের খুঁটি সরিয়ে নেওয়া হবে, কবে তারা আবার নির্ভয়ে পুকুরের জলে নামতে পারবে।
Leave a Reply