গোয়াইনঘাটে আট মাসে শতকোটি টাকার মালিক ওসি রফিকুল | সাপ্তাহিক তদন্ত রিপোর্ট

সোমবার, ০২ Jun ২০২৫, ০৪:১৮ অপরাহ্ন

গোয়াইনঘাটে আট মাসে শতকোটি টাকার মালিক ওসি রফিকুল

গোয়াইনঘাটে আট মাসে শতকোটি টাকার মালিক ওসি রফিকুল

নিজস্ব প্রতিবেদক: ওসি রফিকুল ইসলাম। মাত্র আট মাস অফিসার ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাট থানায়। এই সময়ে হয়েছেন শতকোটি টাকার মালিক। থানায় যোগদানের পরে মুশকিল আসান হিসেবে পরিচিতি পান ওসি রফিকুল। ইতোমধ্যেই তার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। কালো টাকার কুমির এই ওসির বিরুদ্ধে এখনো নেওয়া হচ্ছে না আইনি ব্যবস্তা। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসবে এই ওসির সকল কালো টাকা উপার্জনের উৎস।

জানা গেছে, অসৎভাবে উপার্জিত শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। যার বিশেষ বৈশিষ্ট্য মামলা বাণিজ্য। চোরকারবারিদের ব্যবহার করে ও নিরীহ লোকজনকে আসামি বানিয়ে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। তার সময় গোয়াইনঘাটের চারটি পয়েন্ট চোরাচালানিদের স্বর্গরাজ্য। যেগুলো হচ্ছে বিছনাকান্দি, মাতুরতল, হাজীপুর ও পূর্ব জাফলংয়ের সোনাটিলা এলাকা। এসকল এলাকা ওসি নিজেই দেখভাল করতেন। পুলিশের এই কর্মকর্তা যোগদান করার পর থেকেই নিয়মিত ভারত থেকে ৩০-৪০ হাজার বস্তা চিনির চালান ঢুকত ওইসকল রুট দিয়ে। সকল মুশকিল আসান হিসেবে সুপরিচিত ওসি রফিকুলের ঘুষ ছাড়া হুঁশই থাকে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তোভোগীরা। সে আওয়ামী লীগের লোকজনকে নিয়ে থানা এলাকার প্রতিটি নদীতে পুলিশ পাহারায় ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে হাতিয়ে নিয়েছে দৈনিক কোটি কোটি টাকা। কেউ প্রতিবাদ করলেই ওসি তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতেন।

বিশ্বস্ত একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ৫ই আগস্ট পট-পরিবর্তনের পর নিজ থেকেই থানা থেকে সরে এসেছেন। তার স্থলে নতুন ওসি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ইন্সপেক্টর হারুনুর রশীদ। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১১ই ডিসেম্বর গোয়াইনঘাট থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন রফিকুল ইসলাম। এই সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন।

মূলত নির্বাচন কেন্দ্রিক রদবদলে তাকে গোয়াইনঘাট থানায় পাঠানো হয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে গোয়াইনঘাটে যোগ দিলেও গোটা উপজেলার সীমান্ত এলাকাকে চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেন তিনি। একইসঙ্গে বিরোধীদের দমন-পীড়নও চালান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বিরুদ্ধে টাকার যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেই টাকা কী জীবনে ওরা দেখেছে বা কোন দিন গুনেছে? যারা সবচেয়ে বেশি ফায়দা নিয়েছে তারাই এখন তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে সেগুলো মিথ্যা বলে জানান তিনি। একইসাথে, যে মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। তাতে তিনি নিজেই আক্রান্ত বলে দাবি করেন। একইসাথে, থানায় ভাঙচুর করা হয়েছে। ওই সময় তিনি ঘটনাস্থল এলাকায় থাকার কোনো সুযোগ ছিল না বলে, দাবি করেন।

ভুক্তভোগীরা বলেন, সাবেক ছত্রলীগ নেতা এই ওসির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল মামলা বাণিজ্য। চোরকারবারিদের নিরীহ লোকজনকে আসামি করে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। গোয়াইনঘাটের চারটি পয়েন্ট হচ্ছে চোরাচালানিদের স্বর্গরাজ্য। এগুলো হচ্ছে বিছনাকান্দি, মাতুরতল, হাজীপুর ও পূর্ব জাফলংয়ের সোনাটিলা এলাকায়।

ওসি যোগদান করার পর থেকেই প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার বস্তা চিনির চালান ওইসব রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রকাশ্যেই প্রবেশ করে। আর সব নিয়ন্ত্রিত করতো ওসির দালালরা।

এ ছাড়া- জাফলং, বিছনাকান্দি ও বালু কোয়ারি তার নিয়ন্ত্রিত লোকজনকে দিয়েই পরিচালিত হতো। ইজারাদা ছাড়া গোয়াইনঘাটের বালু মহালগুলো তার আমলেই বেশির ভাগ লুটপাট হয়েছে। ওসির সিন্ডিকেটের সদস্যদের অনেকেই ৫ই আগস্টের পট-পরিবর্তনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্র মতে, গোয়াইনঘাট থানার চোরাই পণ্য থেকে প্রতিদিন ওসির আয় ছিল ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। থানায় বসে এসআই ইমরুল, এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন ও এনামুল হককে দিয়ে টাকা সংগ্রহ করতেন।

তাদের মতে; ওসি রফিকুল ইসলাম নিজেকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে আধিপত্য বিস্তার করেন। তার সঙ্গে গোয়াইনঘাটের সিন্ডিকেটও সক্রিয় ছিল। তিনি নিজেকে কেন্দ্রীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দিতেন। দাপট দেখিয়ে তিনি ৮ মাস শাসন করেন গোয়াইনঘাট। পশ্চিম জাফলং এলাকার লোকজন জানান- কয়েক মাস আগে হাজীপুর এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওসি’র ইন্ধনে চোরাকারবারিদের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

এ সময় প্রকাশ্যে দা, রামদা নিয়ে ওই এলাকায় কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এ নিয়ে ৪-৫টি মামলা হয়েছে। প্রতিটি মামলা ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে ওসি রেকর্ড করেন। পরে কিছু মামলা তার নির্দেশেই সমঝোতায় শেষ হয়। সমঝোতায়ও তিনি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। ৮ মাস গোয়াইনঘাট শাসন শেষে যখন ৫ই আগস্টে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয় তখন ওসি রফিকুল ইসলাম নিজেই ঊর্ধ্বতনদের কাছে আবেদন করে থানা ছেড়েছেন।

এর আগে স্থানীয় ছাত্র-জনতা কয়েক দফা থানা ভাঙচুর করে। এতে থানা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো পুলিশ। পরে অবশ্য সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর থানার কার্যক্রম শুরু হয়।

আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা জানিয়েছেন; ওসি রফিকুলের মধ্যে গোয়াইনঘাটে অতীতে কোনো ওসি এত বাণিজ্য করেননি। তার সময় প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০টি চোরাচালানের ট্রাক গোয়াইনঘাট থেকে বের হয়ে যেতো। এরমধ্যে অর্ধেক চোরাই পণ্য থানার সামনের রাস্তা দিয়ে সিলেটে আসতো। পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করতো।

এসব কারণে ওসির ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন স্থানীয় ছাত্র-জনতা। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ৫ই আগস্ট থানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তারা জানান- পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ওসি নিজ থেকেই থানার দায়িত্ব থেকে সরে এসেছেন। একইসঙ্গে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা চোরাকারবারিরাও এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

গত কয়েকদিন ধরে গোয়াইনঘাটে ওসি রফিকুলের তার অপকর্ম নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে একাধিক হত্যা মামলা রয়েছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Add



© All rights reserved © tadantareport.com
Design BY Web WORK BD
ThemesBazar-Jowfhowo
error: Content is protected !!