বিশেষ প্রতিবেদন
ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে নামমাত্র খরচে, এমনকি ৫০০-১০০০ টাকা খরচ করে নিউজ পোর্টাল তৈরি এবং কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছাড়াই এর পরিচালকদের ‘সম্পাদক’ বনে যাওয়ার একটি প্রবণতা বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যদিও এই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার অংকে নিউজ পোর্টাল তৈরির সরাসরি বিজ্ঞাপন বা প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কঠিন, তবে কম খরচে ওয়েবসাইট তৈরির অনেক সুযোগ এবং ফেসবুক পেজকে নিউজ পোর্টাল হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা এই ধারণাকে সমর্থন করে।
এই সহজে তৈরি হওয়া নিউজ পোর্টালগুলো প্রায়শই সাংবাদিকতার নূন্যতম নৈতিকতা ও নীতিমালা অনুসরণ করে না বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে সমাজে ভুল তথ্য, গুজব এবং অপতথ্যের বিস্তার ঘটছে, যা ‘অপসাংবাদিকতা’ বা ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কীভাবে এবং কেন এই প্রবণতা বাড়ছে?প্রযুক্তিগত সহজলভ্যতা এবং স্বল্প বিনিয়োগের সুযোগের কারণে যে কেউ এখন একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারে।
ওয়ার্ডপ্রেস বা অন্যান্য কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে একটি নিউজ ওয়েবসাইটের কাঠামো দাঁড় করানো তুলনামূলকভাবে সহজ।
এরপর ফেসবুকের ‘বুস্ট’ ফিচার ব্যবহার করে সেই পেজ বা ওয়েবসাইটের প্রচার চালানো হয়, যার মাধ্যমে কম সময়ে অধিক মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ফেসবুক বুস্টিং-এর জন্য বিভিন্ন টাকার প্যাকেজও পাওয়া যায়।
এই ধরনের পোর্টাল তৈরির পেছনে কয়েকটি কারণ সস্তা জনপ্রিয়তা চটকদার শিরোনাম ও বিষয়বস্তু ব্যবহার করে দ্রুত পাঠক আকর্ষণ করা এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
অনেক ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থে সমাজে প্রভাব বিস্তারের জন্যও এ ধরনের পোর্টাল ব্যবহার করা হয়।
সাংবাদিকতার অজ্ঞতা: অভিজ্ঞতার অভাব এবং সাংবাদিকতার নীতিমালা সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে অনেকেই এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না।
সরকারি উদ্যোগ ও নীতিমালার অভাব বাংলাদেশ সরকার অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে একটি নীতিমালার অধীনে আনার চেষ্টা করছে এবং নিবন্ধনের ব্যবস্থা চালু করেছে।
নিবন্ধনের জন্য আবেদনকারী অনলাইন গণমাধ্যমের সম্পাদকের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক বা সমমান হওয়ার একটি প্রস্তাবনাও ছিল।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো বন্ধ করার ঘোষণাও দিয়েছে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনও অনলাইন পোর্টাল নিবন্ধনের নীতিমালা হালনাগাদ করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে।
তবে, এতকিছুর পরেও নামসর্বস্ব ও অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এই ধরনের পোর্টালগুলোর দৌরাত্ম্যে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোর গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
অভিজ্ঞদের উদ্বেগ প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করেন, সাংবাদিকতার মতো একটি দায়িত্বশীল পেশাকে যে কেউ কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই গ্রহণ করলে তা সমাজের জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
তাদের মতে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা, তথ্যের সত্যতা যাচাই এবং নৈতিকতার মতো বিষয়গুলো সাংবাদিকতার মূল ভিত্তি, যা এই ধরনের পোর্টালে প্রায়শই অনুপস্থিত থাকে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাংবাদিকতায় দক্ষতা ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
পরিশেষে, ৫০০-১০০০ টাকায় নিউজ পোর্টাল বানিয়ে ‘সম্পাদক’ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আক্ষরিক অর্থে পুরোপুরি সত্য না হলেও, এর পেছনের মূল অর্থাৎ কম খরচে, সহজে নিউজ পোর্টাল তৈরি করে অভিজ্ঞতা ছাড়াই সাংবাদিক বনে যাওয়া এবং অপসাংবাদিকতার বিস্তার – বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
Leave a Reply